পৌরনীতি ও নাগরিকতাকে বলা হয় নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। কারণ নাগরিকতার সাথে জড়িত সকল বিষয় পৌরনীতিতে আলোচনা করা হয়। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের ‘পৌরনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ অধ্যায়ে পৌরনীতি ও নাগরিকতার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় যেমন- পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের উৎপত্তি, সরকার ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
এ অধ্যায় পড়া শেষে আমরা-
পৌরনীতির ইংরেজি শব্দ সিভিক্স (Civics)। সিভিক্স শব্দটি দুটি ল্যাটিন শব্দ 'সিভিস' (Civis) ও ‘সিভিটাস' (Civitas) থেকে এসেছে । ‘সিভিস' শব্দের অর্থ নাগরিক (Citizen) আর 'সিভিটাস' শব্দের অর্থ নগর রাষ্ট্র (City State) । প্রাচীন গ্রিসে নাগরিক ও নগর রাষ্ট্র ছিল অবিচ্ছেদ্য। ঐ সময় গ্রিসে ছোট ছোট অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠে নগর রাষ্ট্র। যারা নগর রাষ্ট্রীয় কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করত, তাদের নাগরিক বলা হতো। কিন্তু দাস, মহিলা ও বিদেশিদের রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহনের সুযোগ ছিলনা বিধায় তাদেরকে নাগরিক বলা হতো না । বর্তমানে একদিকে নাগরিকের ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে, অন্যদিকে নগর রাষ্ট্রের স্থলে বৃহৎ আকারের জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন- বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার এবং ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। নাগরিক অধিকার ভোগের পাশাপাশি আমরা রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে থাকি। তবে আমাদের মধ্যে যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮ বছরের কম, তারা ভোটদান কিংবা নির্বাচিত হওয়ার মতো রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতে পারে না। তাছাড়া বিদেশিদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার যেমন-নির্বাচনে ভোটদান বা নির্বাচিত হওয়ার অধিকার নেই । মূলত রাষ্ট্র প্রদত্ত নাগরিকের মর্যাদাকে নাগরিকতা বলা হয় । নাগরিকতা ও রাষ্ট্রের সাথে জড়িত সবই ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা'র বিষয়বস্তু। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ই. এম. হোয়াইট যথার্থই বলেছেন, পৌরনীতি হলো জ্ঞানের সেই মূল্যবান শাখা, যা নাগরিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবতার সাথে জড়িত সকল বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে।
পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়ের পরিসর ব্যাপক ও বিস্তৃত। নিম্নে আমরা এর পরিসর বা বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করব-
১. নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য : রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা যেমন রাষ্ট্রপ্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মৌলিক অধিকার ভোগ করি, তেমনি আমাদেরকেও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। যেমন- রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ, আইন মান্য করা, সঠিক সময়ে কর প্রদান করা, সন্তানদের শিক্ষিত করা, রাষ্ট্রের সেবা করা, সততার সাথে ভোটদান ইত্যাদি । নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা'র বিষয়বস্তু। তাছাড়া সুনাগরিকতার বৈশিষ্ট্য, সুনাগরিকতা অর্জনের প্রতিবন্ধকতা এবং তা দূর করার উপায় ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বিষয়ে আলোচনা করা হয় ।
২. সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান : নাগরিক জীবনকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। যেমন- পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, নির্বাচন, রাজনৈতিক দল ইত্যাদি । এদের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও কার্যাবলি পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়ে আলোচনা করা হয় । তাছাড়া সামাজিক মূল্যবোধ, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্য, সংবিধান, জনমত প্রভৃতি পৌরনীতি ও নাগরিকতার আলোচ্য বিষয় ।
৩. নাগরিকতার স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় : আমরা যেখানে বাস করি, সেখানে আমাদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান । যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ইত্যাদি । ঠিক তেমনি নাগরিককে কেন্দ্র করে জাতীয় পর্যায়ে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এসব স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গঠন, কার্যাবলি, অবদান এবং নাগরিকের সাথে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক নিয়ে পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়ে আলোচনা করা হয় ।
৪. নাগরিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ : পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়টি নাগরিকদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে। যেমন- অতীতে নাগরিকতা কীভাবে নির্ণয় করা হতো, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য কেমন ছিল, বর্তমানের নাগরিকের মর্যাদা কিরূপ- এসবের উপর ভিত্তি করে ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা' বিষয়টি ভবিষ্যৎ নাগরিক জীবনের দিকনির্দেশনা প্রদান করে ।
পরিবার হলো সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। সমাজ স্বীকৃত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামী-স্ত্রীর একত্রে বসবাস করাকে পরিবার বলে। অর্থাৎ বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এক বা একাধিক পুরুষ ও মহিলা, তাদের সন্তানাদি, পিতামাতা এবং অন্যান্য পরিজন নিয়ে যে সংগঠন গড়ে উঠে-তাকে পরিবার বলে । মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী আর. এম ম্যাকাইভারের মতে, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনের জন্য সংগঠিত ক্ষুদ্র বর্গকে পরিবার বলে। পরিবার হলো স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গঠিত ক্ষুদ্র সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
আমরা সবাই পরিবারে বাস করি। কিন্তু সব পরিবারের প্রকৃতি ও গঠনকাঠামো এক রকম নয়। কতগুলো নীতির ভিত্তিতে পরিবারের শ্রেণিবিভাগ করা যায়। যেমন- (ক) বংশ গণনা ও নেতৃত্ব (খ) পারিবারিক কাঠামো ও (গ) বৈবাহিক সূত্র ।
ক. বংশ গণনা ও নেতৃত্ব : এ নীতির ভিত্তিতে পরিবারকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় । যথা- পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক পরিবার । পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে সন্তানরা পিতার বংশপরিচয়ে পরিচিত হয় এবং পিতা পরিবারে নেতৃত্ব দেন। আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিবার এ ধরনের । অন্যদিকে, মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে মায়ের বংশপরিচয়ে সন্তানরা পরিচিত হয় এবং মা পরিবারে নেতৃত্ব দেন। আমাদের দেশে গারোদের মধ্যে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়।
খ. পারিবারিক কাঠামো : পারিবারিক গঠন ও কাঠামোর ভিত্তিতে পরিবারকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যথা- একক ও যৌথ পরিবার। একক পরিবার মা-বাবা ও ভাই-বোন নিয়ে গঠিত হয়। এ ধরনের পরিবার ছোট হয়ে থাকে। যৌথ পরিবারে মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি ও অন্যান্য পরিজন একত্রে বাস করে । যৌথ পরিবার বড় পরিবার। বাংলাদেশে উভয় ধরনের পরিবার রয়েছে । তবে বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। মূলত যৌথ পরিবার কয়েকটি একক পরিবারের সমষ্টি ।
গ. বৈবাহিক সূত্র : বৈবাহিক সূত্রের ভিত্তিতে তিন ধরনের পরিবার লক্ষ করা যায় । যথা- একপত্নীক, বহুপত্নীক ও বহুপতি পরিবার। একপত্নীক পরিবারে একজন স্বামীর একজন স্ত্রী থাকে । আর বহুপত্নীক পরিবারে একজন স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে। আমাদের সমাজের অধিকাংশ পরিবার একপত্নীক, তবে বহুপত্নীক পরিবারও কদাচিৎ দেখা যায় । বহুপতি পরিবারে একজন স্ত্রীর একাধিক স্বামী থাকে । বাংলাদেশে এ ধরনের পরিবার দেখা যায় না ।
পরিবারের সদস্যদের সুন্দর ও নিরাপদ জীবন গড়ে তোলার জন্য পরিবার বহুবিধ কাজ করে । পরিবার সাধারণত যেসব কার্য সম্পাদন করে, সেগুলো নিম্নরূপ-
১. জৈবিক কাজ : আমাদের মা-বাবা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলেই আমরা জন্মগ্রহণ করেছি এবং তাদের দ্বারা লালিত-পালিত হচ্ছি । অতএব, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন করা পরিবারের অন্যতম কাজ । পরিবারের এ ধরনের কাজকে জৈবিক কাজ বলা হয় ।
২. শিক্ষামূলক কাজ : আমাদের মধ্যে অনেকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পূর্বেই পরিবারে বর্ণমালার সাথে পরিচিত হই । তাছাড়া মা-বাবা, ভাই-বোন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পারস্পরিক সহায়তায় সততা, শিষ্টাচার, উদারতা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলি শিক্ষা লাভের প্রথম সুযোগ পরিবারেই সৃষ্টি হয়। এগুলো পরিবারের শিক্ষামূলক কাজ। আর পরিবারে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বলে পরিবারকে শাশ্বত বিদ্যালয় বা জীবনের প্রথম পাঠশালা বলা হয় ।
৩. অর্থনৈতিক কাজ : পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি চাহিদা পূরণের দায়িত্ব পরিবারের । পরিবারের সদস্যরা বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে এসব চাহিদা মিটিয়ে থাকে । পরিবারকে কেন্দ্র করে কুটির শিল্প, মৎস্য চাষ, কৃষিকাজ, পশু পালন ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজ সম্পাদিত হয় । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজের জায়গাগুলো অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়েছে এবং নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে । তবে আজও পরিবার আমাদের সকল প্রকার অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করছে ।
৪. রাজনৈতিক কাজ : পরিবারে সাধারণত মা-বাবা কিংবা বড় ভাই-বোন অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে। আমরা ছোটরা তাঁদের আদেশ-নির্দেশ মেনে চলি। তারাও আমাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করেন । বুদ্ধি, বিবেক ও আত্মসংযমের শিক্ষা দেন যা আমাদের সুনাগরিক হতে সাহায্য করে । এভাবে পারিবারিক শিক্ষা ও নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে পরিবারেই শিশুর রাজনৈতিক শিক্ষা শুরু হয়। এ শিক্ষা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় জীবনে কাজে লাগে । এছাড়া বড়দের রাজনৈতিক আলোচনা শুনে ও সে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে আমরা দেশের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি ।
৫. মনস্তাত্ত্বিক কাজ : পরিবার মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মানসিক চাহিদা পূরণ করে । নিজের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে ভাগাভাগি করে প্রশান্তি লাভ করা যায় । যেমন- কোনো বিষয়ে মন খারাপ হলে মা-বাবা, ভাই-বোনদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে তার সমাধান করা যায়। এ ধরনের আলোচনা মানসিক শান্তি-ক্লান্তি মুছে দিতে সাহায্য করে। তাছাড়া পরিবার থেকে শিশু উদারতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণগুলো অর্জন করে যা তাদের মানসিক দিককে সমৃদ্ধ করে ।
৬. বিনোদনমূলক কাজ : পরিবারের সদস্যদের সাথে গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা, গান-বাজনা, টিভি দেখা, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা বিনোদন লাভ করি। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে পরিবারের উল্লেখিত কাজগুলো কিছুটা হ্রাস পেলেও সদস্যদের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনে পরিবারের এসব কাজের গুরুত্ব অপরিসীম।
সমাজ বলতে সেই সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে বোঝায় যারা কোনো সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একত্রিত হয় । অর্থাৎ একদল লোক যখন সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করে, তখনই সমাজ গঠিত হয়। সমাজের এ ধারণাটি বিশ্লেষণ করলে এর প্রধান দু'টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় ৷
যথা-
ক) বহুলোকের সংঘবদ্ধভাবে বসবাস এবং
খ) ঐ সংঘবদ্ধতার পেছনে থাকে সাধারণ উদ্দেশ্য।
তাছাড়া সমাজের সদস্যদের মধ্যে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় ঐক্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা, নির্ভরশীলতা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য ইত্যাদি ।
সমাজের সাথে মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। মানুষকে নিয়ে সমাজ গড়ে উঠে। আর সমাজ মানুষের বহুমুখী প্রয়োজন মিটিয়ে উন্নত ও নিরাপদ সামাজিক জীবন দান করে । সমাজের মধ্যেই মানুষের মানবীয় গুণাবলি ও সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। সমাজকে সভ্য জীবনযাপনের আদর্শ স্থান মনে করে বলে মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই সমাজ গড়ে তোলে । গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল যথার্থই বলেছেন, মানুষ স্বভাবগত সামাজিক জীব, যে সমাজে বাস করে না, সে হয় পশু, না হয় দেবতা। বস্তুত মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমাজে বসবাস করে এবং সামাজিক পরিবেশেই সে নিজেকে বিকশিত করে ।
রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান । বিশ্বের সকল মানুষ কোনো না কোনো রাষ্ট্রে বসবাস করে । আমাদের এই পৃথিবীতে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০ টি রাষ্ট্র আছে । প্রতিটি রাষ্ট্রেরই আছে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং জনসংখ্যা । এ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আরও আছে সরকার এবং সার্বভৌমত্ব। মূলত এগুলো ছাড়া কোনো রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না । অধ্যাপক গার্নার বলেন, 'সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী, সুসংগঠিত সরকারের প্রতি স্বভাবজাতভাবে আনুগত্যশীল, বহিঃশত্রুর নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত স্বাধীন জনসমষ্টিকে রাষ্ট্র বলে ।' এ সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে রাষ্ট্রের চারটি উপাদান পাওয়া যায়। যথা- ১। জনসমষ্টি, ২। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, ৩। সরকার ও ৪। সার্বভৌমত্ব ।
১. জনসমষ্টি : রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য উপাদান জনসমষ্টি । কোনো ভূখণ্ডে একটি জনগোষ্ঠী স্থায়ীভাবে বসবাস করলেই রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে । তবে একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য কী পরিমাণ জনসমষ্টি প্রয়োজন, এর কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই । যেমন- বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি (২০১১), ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১২১ কোটি (২০১১), ব্রুনাইয়ে প্রায় চার লক্ষ (২০১৫)। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, একটি রাষ্ট্রের সম্পদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জনসংখ্যা থাকা বাঞ্ছনীয় ।
২. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড : রাষ্ট্র গঠনের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ড আবশ্যক । ভূখণ্ড বলতে একটি রাষ্ট্রের স্থলভাগ, জলভাগ ও আকাশসীমাকে বোঝায় । রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ছোট বা বড় হতে পারে। যেমন- বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত স্থল সীমানা চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই দু'দেশের মধ্যে পারস্পরিক ছিটমহল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশের মোট ভূখন্ডে ১০,০৫০.৬১ একর জমি যোগ হয়েছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা মামলার রায় বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আয়তন ১৯,৪৬৭ বর্গ কি.মি. বৃদ্ধি পেয়েছে । বর্তমানে ১,১৮,৮১৩ বর্গ কি.মি. সমুদ্র অঞ্চলে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণচীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি রাষ্ট্রের আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড় ।
৩. সরকার : রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরকার । সরকার ছাড়া রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাবলি সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সরকার গঠিত হয় তিনটি বিভাগ নিয়ে । যথা- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। সকল রাষ্ট্রের সরকারের গঠন একই রকম হলেও রাষ্ট্রভেদে সরকারের রূপ ভিন্ন ভিন্ন । যেমন- বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার, আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। রাষ্ট্রের যাবতীয় শাসনকাজ সরকারই পরিচালনা করে থাকে ।
৪. সার্বভৌমত্ব : সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এটি রাষ্ট্রের চরম, পরম ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা। এর দু'টি দিক রয়েছে, যথা- অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের সাহায্যে রাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ জারির মাধ্যমে ব্যক্তি ও সংস্থার উপর কর্তৃত্ব করে। অন্যদিকে, বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্র বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে দেশকে মুক্ত রাখে।
রাষ্ট্র কখন ও কীভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অতীত ইতিহাস ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে কতগুলো মতবাদ প্রদান করেছেন । তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১। ঐশী মতবাদ, ২। বল বা শক্তি প্রয়োগ মতবাদ, ৩ । সামাজিক চুক্তি মতবাদ ও ৪। ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ ।
১. ঐশী মতবাদ এটি রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সবচেয়ে পুরাতন মতবাদ । এ মতবাদে বলা হয়- বিধাতা বা স্রষ্টা স্বয়ং রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন এবং রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি শাসক প্রেরণ করেছেন । শাসক তাঁর প্রতিনিধি এবং তিনি তার কাজের জন্য একমাত্র স্রষ্টা বা বিধাতার নিকট দায়ী, জনগণের নিকট নয় । শাসক যেহেতু স্রষ্টার নির্দেশে কাজ করে, সেহেতু শাসকের আদেশ অমান্য করার অর্থ বিধাতার নির্দেশ অমান্য করা । এ মতবাদকে বিধাতার সৃষ্টিমূলক মতবাদও বলা হয় । এ মতবাদ অনুসারে শাসক একাধারে যেমন রাষ্ট্রপ্রধান এবং অন্যদিকে তিনিই আবার ধর্মীয় প্রধান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ মতবাদকে বিপদজনক, অগণতান্ত্রিক ও অযৌক্তিক বলে সমালোচনা করেন । তাদের মতে, যেখানে জনগণের নিকট শাসক দায়ী থাকে না, সেখানে স্বৈরশাসন সৃষ্টি হয় ।
২. বল বা শক্তি প্রয়োগ মতবাদ এ মতবাদের মূল বক্তব্য হলো- বল বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে এবং শক্তির জোরে রাষ্ট্র টিকে আছে । এ মতবাদে বলা হয়, সমাজের বলশালী ব্যক্তিরা যুদ্ধ-বিগ্রহ বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্বলের উপর নিজেদের আধিপত্য স্থাপনের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এবং শাসনকার্য পরিচালনা করে। এ মতবাদে আরও বলা হয়, সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এভাবেই যুদ্ধ- বিগ্রহের মাধ্যমে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সমালোচকরা এ মতবাদকে অযৌক্তিক, প্রাপ্ত ও ক্ষতিকর বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেন, শক্তির মাধ্যমেই যদি রাষ্ট্র টিকে থাকত তাহলে শক্তিশালী রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামরিক দিক থেকে দুর্বল রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারত না। আসলে শক্তির জোরে নয় বরং সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে উঠে এবং টিকে থাকে ।
৩. সামাজিক চুক্তি गान এ মতবাদের মূলকথা হলো- সমাজে বসবাসকারী জনগণের পারস্পরিক চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্র দার্শনিক টমাস হবসু ও জন শক এবং ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশো সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রবর্তক ছিলেন। টমাস হবস্ जन्म नक এ মতবাদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। তারা প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলত এবং প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে আইন অমান্য করলে শাস্তি দেয়ার কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না। ফলে সামাজিক জীবনে অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। মানুষ হয়ে উঠে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। দুর্বলের উপর চলে সবলের অত্যাচার। এ কারণে মানুষের জীবন কষ্টকর ও দুর্বিষহ হয়ে উঠে। এ ছাড়া প্রকৃতির রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রকৃতির রাজ্যের এ অরাজকতাপূর্ণ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে এবং নিরাপত্তার বিনিময়ে নিজেদের উপর শাসন করার জন্য স্থায়ীভাবে শাসকের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে।
৪. ঐতিহাসিক বা নিবর্তনমূলক মতবাদ এ মতবাদের মূল বক্তব্য হলো- রাষ্ট্র কোনো একটি বিশেষ কারণে হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের বিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন শক্তি ও উপাদান ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে হতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। যেসব উপাদানের কার্যকারিতার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে, সেগুলো হলো- সংস্কৃতির বন্ধন, রক্তের বন্ধন, ধর্মের বন্ধন, যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা ও কার্যকলাপ । ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ সম্পর্কে ড. গার্নার বলেন, 'রাষ্ট্র বিষাভার সৃষ্টি নয়, ফল প্রয়োগের মাধ্যমেও সৃষ্টি হয়নি বরং ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে।' রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মতবাদ । এ মতবাদে রাষ্ট্রের উৎপত্তির সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । আসলে বর্তমানের রাষ্ট্র বহুযুগের বিবর্তনের ফল ।
সরকার রাষ্ট্র গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । সরকার ছাড়া রাষ্ট্র গঠিত হয় না। সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয় । রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে সরকার তিন ধরনের কাজ সম্পাদন করে। যথা-আইন প্রণয়ন, শাসন পরিচালনা ও বিচার-সংক্রান্ত । এ তিন ধরনের কাজ সম্পাদনের জন্য সরকারের তিনটি বিভাগ রয়েছে । যথা- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ । আইন বিভাগ দেশের প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করে, সেই আইন প্রয়োগ করে শাসন বিভাগ সুষ্ঠুভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করে এবং বিচার বিভাগ অপরাধীকে শাস্তি দেয় এবং নিরপরাধীকে মুক্তি দিয়ে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। অতএব সরকার বলতে সেই জনগোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, শাসন পরিচালনা ও বিচার প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত । প্রকৃতপক্ষে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে । সরকার জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ।
রাষ্ট্র ও সরকারের সম্পর্ক প্রাচীনকালে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হতো না। ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই বলতেন, আমিই রাষ্ট্র। তবে আধুনিককালে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে, নিম্নে সেগুলো বর্ণিত হলো-
সুতরাং রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে উল্লেখিত পার্থক্য থাকলেও আমরা বলতে পারি, উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ । একটিকে ছাড়া অন্যটির কথা কল্পনা করা যায় না। রাষ্ট্রকে পরিচালনার জন্যই সরকার গঠিত হয়।